দেশে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। মাসে গড় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০.৪ জন। জুন মাসে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। জুনে আক্রান্ত হয় ৭৩৭ জন। জুলাই মাসে রোগীর সংখ্যা হয়ে যায় দ্বিগুণ। আগস্ট মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৫২১ জনে। এদিকে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে ২৭৫ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর ঢাকায় মোট রোগীর সংখ্যা ২০৪ জন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এ মাসের প্রথম ৮ দিনে মোট ১ হাজার ৭৭০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ১০ জন। চলতি বছর মোট মৃত্যু ৩১ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের এপ্রিলে রোগী ছিল ২৩ জন, মে-তে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন এবং জুলাইতে ১৫৭১ জন। চলতি মাস ও আগামী মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তাদের মতে, চলতি মাসে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর মৌসুম অক্টোবর পর্যন্ত বাড়তে পারে। তারা রোগীদের ঠিকানা নিয়ে ওইসব এলাকায় মশক নিধনের পরামর্শ দিয়েছেন।
ডেঙ্গুর বর্তমান আক্রান্তের অবস্থা বিবেচনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাফ জানিয়ে দিয়েছে, মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সম্ভব হবে না। ঢাকার দুই সিটি (দক্ষিণ ও উত্তর) করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ডেঙ্গুরোগ প্রতিরোধে মশার বিস্তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নগরবাসীকে আরও সচেতন হতে হবে। না হলে অভিযান চালিয়ে বা ওষুধ ছিটিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এবছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানী এবং সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৯৫১ জন। এসব রোগীদের মধ্যে ঢাকায় ৬ হাজার ৪৮ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এক হাজার ৩৪৯ জন। এবছর ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩১ জন। এই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, সাধারণত আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর এই দুই মাস ডেঙ্গুর জন্য পিক সিজন। কিন্তু এবছর জুন থেকেই ক্রমে সংক্রমণ বাড়ছে। যদিও অক্টোবরের প্রথম দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। সিটি করপোরেশনের তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও, নগরবাসী সচেতন না হলে; সহযোগিতা না করলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একটু কঠিনই হবে। যদিও অন্য বছরের তুলনায় এবছরে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কম বলে জানান এই কর্মকর্তা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর এই বিষয়ে বলেন, ময়লা আবর্জনাযুক্ত ড্রেনের পানিতে এডিস মশা জন্মায় না। বরং এই মশা জন্মায় অল্প ও স্বচ্ছ পানিতে। তাই প্রত্যেকে নিজের বাসা-বাড়ির জমে থাকা পানি পরিষ্কার করে ফেললে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে ডেঙ্গু আক্রান্ত কম হবেন। এ ব্যাপারে প্রত্যেক নগরবাসীকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাতিল মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ডেঙ্গু রোগ মূলত যে মশার কামড়ে হয়, সেই মশা আর গ্রামের মশা এক নয়। শহরের এসব মশা অল্প পানিতে ডিম পাড়ে এবং জন্মাতে পারে। যেমন- ডাবের খোসা, ফুলের টব, এগুলোতে খুব অল্প পরিমাণ পানি থাকলেও এর মধ্যেই মশা জন্মাতে পারে। ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। কনস্ট্রাকশনের কাজ করার সময় ওই এলাকায় ড্রামসহ বিভিন্ন কৌটা আর খানাখন্দে পানি জমে থাকে। যা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। যার ফলে সেসব পানিতে ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তার হয়।
ডেঙ্গুকে দৃশ্যমান শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ডেঙ্গু মশাবাহিত একটি রোগ। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে হলে এডিস মশা নিধন করতে হবে। মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে। এক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে সামনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রচারণা থাকলেও নেই কার্যকর ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে সারা দেশের সিটি করপোরেশনগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করছেন অধিকাংশ মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গুর উৎসস্থল ধ্বংসে জন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে না পারলে সামনে বড় বিপদ আসবে।
বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সেই বছর আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়ালেও ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কম ছিল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ডেঙ্গু গৃহপালিত মশার কামড়ে হয়। নগরীর চার পাশের ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থাকায়, নোংরা ড্রেন পরিষ্কার না করায় চলতি বর্ষা মৌসুমে মশার প্রজনন বেড়ে গেছে। করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অথচ নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে এবং মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করলেই মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কিন্তু নগরী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যাদের দায়িত্ব তারা কি তাদের সেই কর্তব্যকাজ সঠিকভাবে করতে পারছেন? সিটি করপোরেশনকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পাশাপাশি জনগণেরও সচেতন হতে হবে। জমাটবদ্ধ স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা হয়। তাই ঘরের আশপাশে পানি জমাটবদ্ধ অবস্থায় রাখা যাবে না। এডিস মশা ঘরের ভেতরেই থাকে। দিনের বেলায় কামড়ায়। তাই এখন থেকে সকলকে সচেতন হতে হবে।
রাজধানীর আজিমপুর, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, মানিকনগর, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মহাখালী, গুলশান ও উত্তরা এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়াদের মধ্যে ১৯৬ জনই ঢাকার বাসিন্দা। এই সময়ে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৮৩ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকাদের মধ্যে ৭০৬ জনই ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আর ঢাকার বাইরে রয়েছেন সর্বমোট ১৮৩ জন রোগী। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৬৭৬ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৬ হাজার ২৪৪ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সর্বমোট রোগী ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৪৩২ জন। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৬ হাজার ৭৫৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৫২৫ জন এবং ঢাকার বাইরে সর্বমোট ছাড়প্রাপ্ত রোগী এক হাজার ২৩১ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে মাত্র ১২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে ২০ জন, মার্চ মাসে ২০ জন এবং এপ্রিল মাসে ২৩ জন ভর্তি হয়। মে মাস থেকে সংক্রমণ কিছুটা ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। ঐ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ১৬৩ জন। জুন মাসে ৭৩৭ জন, জুলাই মাসে ১ হাজার ৫৭১ জন এবং গত আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫২১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে রাজধানীতে আক্রান্তের হার বেশি। তিনি বলেন, এডিস মশা নিধন করতে হবে। একই সঙ্গে এডিস মশার উৎসস্থল ধ্বংস করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এক ব্যক্তি একাধিক বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার জন্য ঝুঁকি বেশি। তাই এখন থেকেই সবার সচেতন হতে হবে। অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু জ্বর হলো ব্যাকবোন ফিভার। ডেঙ্গু হলে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, সারা শরীরে র্যাশ ওঠে ও ১০৩-১০৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার জ্বর আসে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল ওষুধ খেতে হবে। এসপিরিন জাতীয় কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। প্রচুর পানি খেতে হবে। একই সঙ্গে সিভিসি পরীক্ষা করিয়ে দেখতে হবে। প্লাটিলেট যদি ১ লাখের নিচে নেমে আসে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, বর্তমানে যে আবহাওয়া দেশে বিরাজ করছে, সেটা ডেঙ্গুর মৌসুম। হঠাৎ বৃষ্টি আবার গরম। বাসা বাড়ি ও আশপাশে স্বচ্ছ পানি জমাট বেধে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। এডিস মশার উৎসস্থল ধ্বংস করতে না পারলে সামনে ভয়াবহ বিপদ আসবে। সময় থাকতে সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু এখন সারা বছর হলেও এই সময়টাতেই বেশি হয়। মশা নিধনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে জনগণকেও সচেতন করতে হবে।