অপেক্ষার পালা শেষ। দ্বার খুললো দেশের প্রথম ছয় লেনের দৃষ্টিনন্দন মধুমতি সেতুর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সোমবার দুপুর ১২টায় তার কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই সেতু উদ্বোধন করেন। নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী কালনাঘাট এলাকায় নির্মিত মধুমতি সেতু উদ্বোধনের খবরে উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলালের ১০ জেলার কোটি মানুষ। তাদের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হলো। যোগাযোগ সহজ করার পাশাপাশি খুলে দেবে বাণিজ্যে সম্ভাবনার দ্বার। আজ রাত ১২টায় জনসাধারণের চলাচলের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সেতুটি। এর মধ্যদিয়ে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব কমে আসবে ৮৬ কিলোমিটার।
নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালনা সেতু’ নামকরণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে কালনা সেতুর নাম ‘মধুমতি সেতু’ নামকরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়েছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এ অঞ্চলের মানুষ। এদিকে রাতের দৃষ্টিনন্দন আলোয় মধুমতি সেতুর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সেতুতে প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসছেন এখানে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে মধুমতি নদীর উপর ৬৯০ মিটার দীর্ঘ মধুমতি সেতু নির্মিত হয়েছে যা স্থানীয়ভাবে কালনা সেতু নামে পরিচিত। এটি নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর এবং ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে, সেতুটি চালু হওয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ দ্রুত সড়ক যোগাযোগ সুবিধা পাবে। কারণ, সেতুটি কালনাঘাট থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব কমিয়ে দেবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১০টি জেলার মানুষ কম সময়ে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে পারবে। এটি দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ভ্রমণের সময়ও কমিয়ে দেবে, কারণ, এতে ঢাকা থেকে দূরত্ব হবে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার।
প্রকল্পের কর্মকর্তাদের মতে, মধুমতি সেতুটি এশিয়ান হাইওয়ের একটি অংশ যা রাজধানীকে দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
২৭.১ মিটার চওড়া সেতুটিতে চারটি উচ্চ গতির লেন ৪.৩০ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং দুটি সার্ভিস লেনসহ ছয়টি লেন রয়েছে।
যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, সেতুটি এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে সহজ করবে।
বেনাপোল স্থলবন্দর, মংলা সমুদ্র বন্দর ও নোয়াপাড়া নদী বন্দরের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের বাসিন্দারা একদিনের মধ্যে ঢাকায় তাদের কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে পারবেন। সেতুটি চালু হলে কালনা ফেরি ঘাট হয়ে যেতে তাদের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হবে বলে জানান কয়েকজন যাত্রী।
পুরোপুরি এ সেতুর সুফল পেতে নতুনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে সড়ক অবকাঠামো। বেনাপোল থেকে যশোর হয়ে নড়াইলের কালনাঘাট ও ভাঙ্গা পর্যন্ত গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন ১৩০ কিলোমিটার ছয় লেন সড়ক। ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে নকশা তৈরির কাজ, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দাতা সংস্থার সঙ্গে চলছে সংলাপ। ছয় লেনের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে ডিসেম্বরে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ কাজের সম্পূর্ণ খরচ দিতে চায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইকোনমিক ইনভেস্টর (এআইআইডি)। আগামী ৩ মাসের মধ্যে ভারত এবং এআইআইডি থেকে অর্থ ছাড় হবে এমনটি আশা করছে সওজ। তবে আপাতত কালনা-নড়াইল-যশোর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণে মোট ৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। মধুমতী সেতুর উদ্বোধনের দিন হতে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর নিরাপদে যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কটির দুপাশে মোট ৬ ফুট প্রশস্ত করা হচ্ছে বলে সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পরিচালক শ্যামল ভট্টচার্য বলেন,স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সুফল এরইমধ্যে পেয়েছি। কিন্তু সেই সুফল পুরোপুরি পেতে নড়াইল, যশোরসহ এ অঞ্চলের যেসব স্থলবন্দর রয়েছে বা অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের জন্য এ মধুমতি সেতুর কানেকশন জরুরি ছিল। সোমবার সেই স্বপ্নপূরণ হলো। এটা কেন ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক সে সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এ অঞ্চলের সাব-রিজিনিওয়াল কানেকটিভিটি মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে।’